এই ঝরঝর ঝরে পড়া শ্রাবণধারা আমি বুঝিনি। সত্যি আমি বুঝিনি এটা কী প্রকৃতির বৃষ্টি বিলাস না কী তার হৃদয় নিংড়ানো কষ্টেরই বারিধারা!
আমার এ দু`চোখ বড় সাদামাটা। চঞ্চল প্রকৃতির স্নিগ্ধ নীল আকাশে বঙ্গোপসাগরের কান্না উড়ে গিয়ে কখন যে জমাট বেঁধেছিল আমি বুঝতেই পারিনি। আমি ভাওয়ালের গড়ে অনেক হেঁটেছি কিন্তু কোন দিন খেয়ালই করিনি শালবনের মাথায় অন্ধকার ধীরে ধীরে কখন ঘন বাসা বেঁধেছে।
নক্ষত্র ঝরে পড়ার খবর শুনে আমি খুব করে কেঁদেছিলাম। সেদিনও থেমে থেমে কেঁদেছিল আকাশ। ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়েছিল তার বুকে জমে থাকা মেঘরূপী কান্নাগুলি। শুধু আকাশ আর আমি নয়- লক্ষ কোটি মানুষও কেঁদেছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে বাংলা সাহিত্যাকাশের অনন্য উজ্জল নক্ষত্রের অকাল পতনের খবর শুনে।
আমরা সবাই খুব করে কেঁদেছিলাম। আবাল বৃদ্ধ বনিতা চাষাভুষা সবাই। সেদিন মাঝ রাত থেকে আজ পর্যন্ত আমরা কেঁদেই চলেছি। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জীবন্ত কিংবদন্তীর চিরবিদায় মুহূর্ত থেকে আজ অবধি থেমে থেমে কেঁদে যাচ্ছে আকাশও।
নুহাশ পল্লীকে বাহুতে আগলে রাখা শাল বন এখনো মাথা নুইয়ে রেখেছে। অবিরাম অশ্রু বিসর্জন এখনও শেষ হয়নি হাজারটা গাছের পাতায় এখনও তা টলমল করে। আকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা লিচু বাগানের আশেপাশের বাড়ন্ত জলপাই গাছগুলো শোকে যেন পাথরের মত থমকে আছে।
আশা ছিল কোন এক ফেব্রুয়ারীর কোমল বিকেলে দেখা হবে, কথা হবে তার সাথে। কথার যাদুকর খস খস করে যাদুর কাঁঠি থেকে রং ঝরিয়ে তাঁর লেখা কোন বইয়ের প্রথম পাতাতেই লিখে দিবেন- ‘অনেক অনেক বড় হও’। হয়ত আরও দু একটা শব্দ লিখতেন, সমাপ্তি টেনে লিখতেন- শুভ কামনান্তে, হুমায়ুন আহমেদ।
আমার সে আশা আর এ জনমে পূর্ণ হবার নয়। তবে তাঁর সাথে আমার অন্য রকম সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রথম আর শেষ দেখার সেই ভর দুপুরটায় আকাশ অঝোর ধারায় কেঁদেছিল। কান্নার বন্যায় পথ ঘাট সবই ভাসিয়ে দিয়েছিল।
সকালে অগ্রজ প্রতিম প্রিয় মোঃ আক্তারুজ্জামানের ফোন পাই- অচিনপুরে চলে যাওয়া মানুষটা আজ নুহাশপল্লীতে অন্তিম শয্যায় শায়িত হবেন। চলুন না, একবার শেষ দেখাটা দেখে আসি!
দ্বিরুক্তি না করে আমি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমরা নূহাশ পল্লীতে পৌঁছার আগেই কয়েক বার ভিজেছি।
দুইপাশে আকাশ ছোঁয়া গজারি, শাল আরও কত নাম জানা, অজানা সারি সারি শ্যামল বৃক্ষরাজি । মাঝখানে পিচ ঢালা পথ। সরু রাস্তার দুপাশের মাটি মানুষের পদ পীড়নে হয়ে গেছে চরম পিচ্ছিল। তবু সবাই কোন প্রকার বিরক্তি আর ক্লেশবিহীন ভাবে সামনে এগিয়ে গেছে।
পিচঢালা পথটুকু চলে গেছে গাড়ীর দখলে। মিসির আলী, হিমুদের উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরা ফেরা নেই, ওরা নির্বাক মুখে পা চালিয়ে গেছে সংকীর্ণ পথে দ্রুত চলার আপ্রাণ চেষ্টা। মাঝে মাঝে দু একটা শব্দ যদিও বা কানের পর্দা স্পর্শ করেছে তা শুধুই- নুহাশ পল্লী নয়ত হুমায়ুন স্যার! সবার মুখ থেকেই অন্য কথাগুলি যেন কোন অজানায় হারিয়ে গেছে।
নারী পুরুষ, যুবা বৃদ্ধ কিংবা শিশু কিশোর ভিড় বৃষ্টি কোন কিছুকেই কেউ তোয়াক্কা করেনি। এ যেন সামনে এগুবার মিছিল। প্রিয় মানুষের সাথে সাক্ষাতের ঠিকানায় পৌঁছানোর আপ্রাণ, অক্লান্ত চেষ্টা।
আমরা দুজন ভিড়ের তোরে রাস্তায়ই একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি বার কয়েক। ঝম ঝম বৃষ্টিতে দেখেছিলাম সেগুন গাছের বড় বড় পাতাগুলো অনেকের মাথার ছাতা হয়ে গিয়েছে।
একবার আক্তার ভাইয়ের মোবাইলে রিং দিয়ে বলেছি- আক্তার ভাই রাস্তায় মানুষের ভিড় আর বৃষ্টির যে অবস্থা, কী করবেন?
- দেরি করলে বৃষ্টি আর মানুষের ঢল দুটোই বাড়বে, চলেন হাটি। আক্তার ভাইয়ের তাগাদা পেয়ে আবার সামনে এগিয়ে গেছি। হেঁটেছি আর ভেবেছি এই অজ পাড়াগাঁ আজ ইতিহাসে জায়গা করে নিল। পৃথিবী সৃষ্টির পর প্রথমবার এই পথে এক সঙ্গে এত লোক হেঁটেছে তাতে কারো বিন্দু পরিমাণ সন্দেহের অবকাশ নেই।
হাজার মানুষের স্রোতের মাঝেও পথ ঘাট কেমন শুনশান, নীরব। আশপাশে বাড়ি ঘর খুব কম। নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ। বনের সরু পথ দিয়ে যেতে যেতে শুনেছি নীচু গলায় কেউ বৃক্ষ প্রেমিক মানুষটার পছন্দের তারিফ করছেন।
একজন সাহিত্যিক, একজন সৃষ্টির নেশায় ডুবে থাকা মানুষের প্রকৃতিকে সীমাহীন ভালবাসারই অসামান্য নিদর্শন নুহাশ পল্লী। চান্নি পসর রাইতে দূর্বা ঘাসের সবুজ গালিচায় দাঁড়িয়ে মিষ্টি জ্যোৎস্নায় ভিজতে একটা নুহাশ পল্লী কতটা ভুমিকা রাখতে পারে সেটা এই কালজয়ী মানুষটা খুব ভালই জানতেন। বৃক্ষ রাজির সাথে দাঁড়িয়ে দু দণ্ড কথা বলতে এমন স্থান নির্বাচন কতটুকু সঠিক নুহাশ পল্লী সৃষ্টির মধ্য দিয়ে হুমায়ুন আহমেদ যেন তা মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন।
আকাশ ছোঁয়া গজারী গাছগুলির পায়ের কাছ দিয়ে হেঁটে গিয়ে আমি নুহাশ পল্লীর প্রবেশ দ্বারের ঠিক সামনে আরেকবার আক্তার ভাইকে হারিয়ে ফেলি। মনে মনে ভাবি কিছুটা আমরা একা একাই থাকি, নিজেকে অন্য ভাবে দেখি।
ভিতরে ঢুকেই আমার বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠে। খানিক দূরে লেখকের প্রিয় বৃষ্টি বিলাস ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মাঠময় লেখকের স্পর্শ পাওয়া গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হয় বৃক্ষ প্রেমিকের বিদায় বেলা ওরাও হৃদয় ভাঙ্গার ব্যথায় ব্যথিত। ওদের মুখে ভাষা নেই কিন্তু ওরা চোখের কোণে ছলছল জল নিয়ে তাকিয়ে আছে।
‘নন্দিত নরকে’ রচনার মধ্য দিয়ে এই মহান লেখক এদেশের মানুষকে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর উপস্থিতি জানান দিয়েছিলেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার পেয়ে আলোকিত হন বাংলা সাহিত্যাকাশে। তারপর আর পিছু ফিরে তাকাননি মানুষটা। আরো অনেক পুরষ্কারে হন পুরুষ্কৃত।
হিমু, মিসির আলী কিংবা বাকের ভাই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মূলত মানুষকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন। নিজেও মানুষের ভালবাসায় ধন্য হয়েছেন এই গুনী শিক্ষক, সাহিত্যিক, নাটক ও চলচিত্র নির্মাতা।
সহসাই মানুষের শশব্যস্ততায় সম্বিৎ ফিরে পাই। দেখি সবাই কাঁদছে- আকাশের কান্না ঝুম বৃষ্টি হয়ে ঝরে যাচ্ছে, কাঁদছে বৃক্ষরাজি। নুহাশ পল্লী যেন নিঃস্তব্ধ হয়ে যায়। ঠায়, নীরব, স্থির হয়ে আছে ঘাস, পুকুর, ভূত বিলাস, খেজুর বাগান- সব কিছু ।
মরিলে কান্দিস না আমার দায়- কাউকেই প্রবোধ দিতে পারেনি। আত্মীয়, পরিজন, ভক্ত অনুরাগীর হৃদয় ভাঙ্গা কান্নার মধ্য দিয়েই এই মহান লেখকের বর্ণীল জীবনের শেষ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি টানা হয়।
প্রিয় সন্তান সন্ততি, ভক্ত অনুরাগীদের শোকের অকূল পাথারে ভাসিয়ে প্রিয় অঙ্গনের লিচু তলায় চির শায়িত হন।
আহাজারিতে নূহাশ পল্লীর বাতাস তখন ভারী হয়ে উঠেছিল। তেতুল, কামরাঙ্গা, লিচু আর জলপাই বাগান তখন তাকিয়ে ছিল প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর উদ্যমী মানুষটার শ্রান্ত, ক্লান্ত নিথর দেহটির মহা প্রস্থানের পথ পানে।
ওরাও কি বুঝতে পেরেছিল? এই নিথর দেহ আর কোনদিন ওদেরকে ছুঁয়ে দেখবে না। গায়ে পরম মমতায় হাত বুলাবে না। হবে না দেখা, আর কোন দিন হবে না কোন কথা। সেই হাতে রোপিত হবে না আর কোন নতুন চারা। ঠিক যেমন কোন পাতায় কাটবে না আর কালির আঁচড়; বর্ণমালারা শব্দ হয়ে কারো হৃদয়ে তুলবে না গুঞ্জন।
ফেরার খানিক আগেও বিক্ষিপ্ত ভাবনা নিয়ে বাগান ঘুরে ঘুরে ছোট বড় সবুজ গাছ ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করেছি তাঁর ছোঁয়ার অনুভূতি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবতে চেয়েছি তার সাহিত্য ভাবনায় গাছের প্রতি অকৃত্রিম মমতা।
বৃষ্টি বিলাসী মানুষটার সাথে আর কারো কোনদিন দেখা হবে না, হবে না কোন কথা। তবু তাঁর সাথে আমার প্রথম এবং শেষ দেখাটি কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে। উনার সৃষ্ট সুবিশাল কর্ম যজ্ঞের মধ্যেই উনি আমাদের হৃদয়ে সব সময় বর্তমান হয়ে থাকবেন। একজন হুমায়ুন আহমেদের কাছে থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা কখনো অতীত হতে পারে না।
প্রচন্ড ভিড়ে আক্তার ভাইকে মোবাইল ফোনে ডেকে আমরা আবার একত্রিত হই। ঘরে ফেরার পালা। মনের অজান্তেই একবার পিছন ফিরে দেখি প্রিয় লেখকের ‘বৃষ্টি বিলাস’কে। বৃষ্টি বিলাসী মানুষটাকে শেষ ভালোবাসা জানাতে তখনও মুষলধারে ঝরে পড়ছে বৃষ্টি!
২২ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪